রাকিব হোসেন মিলন
বিশেষ প্রতিনিধি।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে তাদের জোট শরিকদের দখলে থাকা সাতটি আসনেও প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। দলীয় প্রার্থী ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের কথায় মোটামুটি পরিষ্কার—নির্বাচনের মাঠে গুরুত্ব হারিয়েছে শরিকেরা। এতে স্বভাবতই নাখোশ কয়েকটি শরিক দল। দলগুলোর নেতারা বলছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ তাদের ছাড়াই নির্বাচন করতে চায়।
গত রোববার ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট এবং বিকল্পধারার ৯ এমপির আসনেও প্রার্থী দিয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। তবে জোটের শরিক জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর আসন (কুষ্টিয়া-২) ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমানের (নারায়ণগঞ্জ-৫) আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। সেলিম আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বড় ভাই।জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছিল, বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও তারা জোটে নির্বাচনে অংশ নেবে। কিন্তু কোনো রকমের আলোচনা ছাড়াই তাদের আসনে প্রার্থী দিল আওয়ামী লীগ।
জোটের শীর্ষ দুই নেতার আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শক্তিশালী প্রার্থীও দেওয়া হয়েছে। আসন দুটো হলো বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের ঢাকা-৮। এই আসনে প্রার্থী হচ্ছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আর ফেনী-১ আসনের বর্তমান এমপি জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাছিমকে। সমঝোতা হলেও আসন দুটি পাওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে জোটের নেতাদের মধ্যে।
এ বিষয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তারা (আওয়ামী লীগ) এককভাবে থাকতে (নির্বাচনে) চায়। তারপরও আমরা এককভাবে নির্বাচনে যাব।’
আর সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘এত দিন নির্বাচন জোটগতভাবে হয়েছে। আমরা আশা করি এবারও জোটগতভাবে হবে। কিন্তু সেটা নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের ওপর।’
নির্বাচনী জোটের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র এবং সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু গতকাল বলেন, ‘এটা নেত্রী (শেখ হাসিনা) সবার সঙ্গে বসে ঠিক করবেন।’ বৈঠকটা কবে হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনি (শেখ হাসিনা) সময় দেবেন।’
তবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘নির্বাচনী জোট নিয়ে এখনো নতুন করে ভাবনা নেই। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেখি কারা কারা নির্বাচনে আসে। তারপরে দেখব।’
এদিকে জোটের এক নেতা দাবি করেন, নির্বাচন নিয়ে জোটে কোনো ধরনের মনোমালিন্য তৈরি হলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে একা হয়ে যাবে। এটা নিশ্চয়ই দলটির সভাপতি জানেন এবং বোঝেন। শুধু নির্বাচনের সময় নয়ভোটের পরের পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য চেষ্টা করা হবে। সেখানে জোটের দলগুলো তাঁর (শেখ হাসিনা) পক্ষে না থাকলে কেউ থাকবে না। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সে পরিস্থিতিতে যেতে চাইবে না।
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করলে জোটে মনোমালিন্য হবে কি না, এমন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘তা তো কিছুটা হবেই। কথা ছিল আমরা সংগ্রাম, আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে করব। সেটা যখনা, তখন তো কিছুটা মনোক্ষুণ্ন হবেই।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির মন্তব্য, ‘এই মুহূর্তে শুধু নির্বাচন না, দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াতসহ দেশি-বিদেশি চক্রদের যে চক্রান্ত চলছে, তা মোকাবিলা এবং নির্বাচনের পরে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে যুদ্ধ হবে, তা মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গী হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের গুরুত্ব অনেক। তাই আমাদের জোট আছে এবং থাকবে।’
একাদশ জাতীয় সংসদে প্রথমে২৩০ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ। এরপর নির্বাচন কমিশনে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা জমা দেয় দলটি। সে সময় ২৫৮টি আসনে দলীয় প্রার্থীকে নৌকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টিকে পাঁচটি, জাসদকে তিনটি, তরীকত ফেডারেশনকে দুটি, বাংলাদেশ জাসদকে একটি এবং বিকল্প ধারাকে তিনটি আসনে নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। এবারও সেই রকম হবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।সচিবালয়ে গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমরা ১৪ দলীয় জোটবদ্ধগত নির্বাচন করব, সেটি আগেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আপনারা জানেন, ২০০৮ সালেও আমরা জোটবদ্ধ নির্বাচন করেছিলাম। সেবারও কিন্তু প্রায় ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। পরে মহাজোটের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছিল। গতবারও তা-ই করা হয়েছিল। এবারও ২৯৮ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। পরে জোটের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণার সঙ্গে জোটের কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। তিনি বলেন, ‘জোটের তালিকা নিয়ে আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে, তার ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।’ তখন আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী ছাঁটাই করবে বলে মনে করেন ইনু।
তবে ইনুর এই আশা আবার হালকা হয়ে যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। শরিকদের সঙ্গে জোটের বিষয়ে তিনি বলেছেন, নতুন নতুন সময়ে নতুন নতুন কৌশলও দলকে গ্রহণ করতে হয়।রাজধানীতে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গী খোঁজার কোনো দরকার নেই। দেশের জনগণই আওয়ামী লীগের সঙ্গী ও বন্ধু।’
Discussion about this post