রাকিব হোসেন মিলন
সড়কে প্রতিদিন লাখো মানুষ, হাজারো যানবাহন। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশকে শৃঙ্খলিত করতে যে বাহিনী নিরলস কাজ করে চলেছে, তারা হলেন ট্রাফিক পুলিশ। দিন-রাতের ক্লান্তিহীন পরিশ্রমে তারা নাগরিকদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করে চলেছেন। কিন্তু এই অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন কতটুকু হচ্ছে?
ট্রাফিক পুলিশের কাজ শুধু নির্দেশনা দেওয়া নয়, বরং এটি এক অবিরাম যুদ্ধ। প্রখর রোদ, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা শীতের কনকনে ঠান্ডা—যে পরিস্থিতিই হোক, তাদের দায়িত্বে অবিচল থাকতে হয়। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে গিয়ে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যায় ভোগা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের জন্য সাধারণ ঘটনা। ধুলাবালি, গাড়ির ধোঁয়া, এবং অবিরাম শব্দদূষণের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করার ফলে তারা শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ এবং হৃদরোগের ঝুঁকিতে থাকেন। অনেক অনেক পুলিশ সদস্য বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েও পেশাগত ডিউটি করছেন। এগুলোকে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে।
কর্মঘণ্টারও যেন শেষ নেই। কখনো দুর্ঘটনা, কখনো বিশেষ অভিযান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ভিআইপি মুভমেন্ট সামলাতে গিয়ে তাদের ডিউটির সময় অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হয়। তবুও তারা পেশাগত দায়িত্ব থেকে এক চুলও পিছিয়ে আসেন না।
ট্রাফিক পুলিশ শুধু যানজট নিরসনেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত সড়ক ব্যবস্থাপনা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ, এবং ড্রাইভারদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করার মাধ্যমে দুর্ঘটনার হার কমানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বিভিন্ন উৎসব বা ছুটির সময়ে যখন সড়কে যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়, তখন তাদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ককে নিরাপদ রাখতে কাজ করে যান।
আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পেশায় জনবল সংকট প্রকট। গনমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি জনবলের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন।
সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাবও তাদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে এখনও অনেক জায়গায় প্রাথমিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের কাজকে আরও কার্যকর এবং মানবিক করতে হলে সরকারি এবং সামাজিকভাবে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। কিছু বিশেষ জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
১.স্বাস্থ্যসেবা ও বীমা সুবিধা: দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি কমাতে তাদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চিকিৎসা সুবিধা এবং বীমার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
২. পুনর্বাসন ও আবাসন সুবিধা: আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করলে তাদের মানসিক চাপ কমবে। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বসবাসের সুযোগ তাদের কাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
৩. প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম: আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করা সম্ভব। ইলেকট্রনিক সিগন্যাল, ক্যামেরা মনিটরিং, এবং ড্রোন ব্যবহারের মতো প্রযুক্তি তাদের কাজের গতিশীলতা বাড়াবে।
৪. জনবল বৃদ্ধি: পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করলে কাজের চাপ কমবে এবং সেবার মান উন্নত হবে।
ট্রাফিক পুলিশের কাজকে সম্মানের চোখে দেখা উচিত। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ না করে বরং তাদের সহায়তা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। নিয়ম মেনে চলা এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মাধ্যমে আমরা তাদের কাজকে সহজ করতে পারি।
ট্রাফিক পুলিশ আমাদের নিরাপদ সড়ক ও শৃঙ্খলিত চলাচল নিশ্চিত করার পিছনে যে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তা কখনোই উপেক্ষা করার মতো নয়। তাদের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি প্রদর্শনের পাশাপাশি সরকারের উচিত তাদের জন্য আরও উন্নত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা। ৫ আগস্টের পর নতুন এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহবান থাকবে ট্রাফিক পুলিশের কাজের স্বীকৃতি দিলে, উন্নত সূযোগ সুবিধা নিশ্চিত করলে, তারা আরও অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবেন, যা সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের জন্যই ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
Discussion about this post