বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে অল্পের জন্য বেঁচে আছেন চবি’র সাহসী ছাত্র রাহাত।
জুনায়েদ খান রাহাত চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যায়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ২১-২২ সেশনের মেধাবী ছাত্র। কোটা আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি শিক্ষার্থীদের প্রতিটি কর্মসূচিতে অগ্রভাগে ছিলেন।
গত ৫ আগস্ট সকালে ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থান করেছিলেন তিনি। এ সময় স্বৈরাচারী শাসকের দোসর পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা চারিদিক থেকে অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলাকারীদের ছোঁড়া একটি বুলেট তার গলায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই মাটিতে পড়ে যান তিনি। রক্তে লাল হয়ে যায় তার পুরো শরীর।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরের যন্ত্রণার স্মৃতি মনে করতে গিয়ে রাহাত বাসস’কে জানান, ওইদিন কয়েকজন অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত শিক্ষার্থীদের ওপর শটগান, পিস্তল, রিভলবার, শুটারগান দিয়ে গুলি চালায়। নগরীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে শুরু করে তিনপুলের মাথা পর্যন্ত ছাত্রদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে তারা। সংঘর্ষে তিনিসহ অনেক ছাত্র আহত হন।
তিনি বলেন, এক পর্যায়ে গলায় গুলি লাগার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। সহপাঠীরা তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে পরে ভর্তি হাসপাতালে ভর্তি করান। তার অনেক রক্তপাত হয়েছিল। চারদিন সেখানে থাকার পর কিছুটা শঙ্কামুক্ত হলে চিকিৎসকদের অনুরোধ করে তিনি বাসায় ফিরে আসেন।
তিনি জানান, ‘মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ডাক্তাররা বলেছেন, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত আছে। আপনাকে বিদ্ধ করা গুলিটি এক-আধ ইঞ্চি পাশে বা নিচে লাগলে ঘটনাস্থলেই আপনার মৃত্যু হতো। কোনোভাবে মেডিকেল আনা গেলেও আমাদের পক্ষে আপনাকে বাঁচানো কঠিন হতো।’
রাহাত বলেন, ‘বৈষম্যমূলক কোটা প্রথা আমাদের জন্য ছিল নিত্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ। সব শিক্ষার্থীরই স্বপ্ন থাকে পড়াশোনা শেষ করে যোগ্যতা দিয়ে ন্যায্য চাকুরির সুযোগ পাওয়ার। কিন্তু কোটা প্রথার বৈষম্যমূলক ফাঁদে বছরের পর বছর আমাদের সোনালী স্বপ্নগুলো আটকে ছিল। কোটার সুযোগ নিয়ে অনেক অযোগ্য মানুষ ভালো চাকুরির সুযোগ পাবে, অথচ অধিকাংশ যোগ্য শিক্ষার্থী বঞ্চিত হবে- একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের এ কেমন বিমাতাসূলভ আচরণ? আমরা এ বৈষম্য মেনে নিতে পারছিলাম না।’
তিনি বলেন, ‘৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে পুরো দেশে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ও বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।
এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। ঈদুল আযহার জন্য আন্দোলন কিছুদিনের জন্য বিরতি ঘোষণা করা হয়। ১ জুলাই থেকে আন্দোলন আবার দানা বাঁধতে থাকে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সারাদেশের সাধারণ জনগণের মাঝে।
চট্টগ্রামে এ আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা শুরুতে এককভাবে আন্দোলন করলেও পরে সেখানে স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হন। তারা দিন দিন আন্দোলনকে তরান্বিত করতে থাকেন। তাদের এই আন্দোলন আস্তে আস্তে স্বৈরশাসকের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।’
শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা কোটা এবং আন্দোলনের সময়ের কষ্ট ও মৃত্যুভয় প্রতিনিয়ত তাড়া করতো জানিয়ে রাহাত বলেন, ‘এ রকম বৈষম্য বাংলাদেশে যেন আর কখনো ফিরে না আসে। আন্দোলন করতে গিয়ে নিজের শরীরে যে ক্ষত হয়েছে এতে আমার বিন্দু পরিমাণ কষ্ট নেই। কারণ আমাদের কষ্ট সফল হয়েছে। আমাদের যৌক্তিক দাবি পূরণ হয়েছে, স্বৈরচারের পতন হয়েছে।’
রাহাত আশাবাদ, ‘আমাদের দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন এবার পূরণ হবে ইনশাল্লাহ। মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের উপযুক্ত জায়গায় স্থান পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আহ্বান থাকবে, সরকার যেন চাকুরির সব বৈষম্য দূর করে। দেশে বিরাজমান ফ্যাসিবাদী সিস্টেমকে হটিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন সরকার যেন তাদের এই কষ্ট এবং শ্রম বৃথা যেতে না দেয়।’
তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখেন, নোবেল বিজয়ী ড. মো. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার যেন প্রতিটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বন্ধ করে। প্রতিটি ক্যাম্পাস যেন মাদক ও তথাকথিত রাজনীতিমুক্ত হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক দাবিগুলো যেন মূল্যায়ন করা হয়। আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা যেন গর্ব করতে পারি। সবার মতামতের ভিত্তিতে সরকার একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে বলে আমরা আশাবাদী।’
জুনায়েদ খান রাহাত কক্সবাজার জেলার চকরিয়া পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের মৃত নুরুল হক ও জান্নাত আরার পুত্র। তারা ৪ বোন ১ ভাই।
Discussion about this post