নিজস্ব প্রতিবেদক
বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত এক শিশুকে গত রোববার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে
বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত এক শিশুকে গত রোববার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বাগেরহাটে প্রতিদিন বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে রোগী আসছে বাগেরহাট ২৫০ শয্যা হাসপাতালে (সদর হাসপাতাল)। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের শয্যাসংখ্যার কয়েক গুণ রোগী ভর্তি হচ্ছে। জনবল বৃদ্ধি করার পরেও চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। ডায়রিয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ পানি পান এবং স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
বাগেরহাট সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে বাগেরহাট হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় ২০০ রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮০ ভাগই শিশু। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাত শতাধিক ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
জেলার মধ্যে আক্রান্তের দিক থেকে ফকিরহাটের অবস্থান শীর্ষে। ফকিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সূত্রমতে, প্রতিবছর এই সময়ে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ে। তবে এ বছর আগাম আক্রান্তের সংখ্যা দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে আক্রান্তের দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে ফকিরহাট সদর।
এক সপ্তাহে শতাধিক মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে। বাগেরহাট সদর ও মোল্লাহাট উপজেলারও অনেক মানুষ এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে।
তীব্র দাবদাহ, সুপেয় পানির সংকট, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব, ইফতারে বাইরের ভাজা খাবারসহ বিভিন্ন কারণে সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহ্ মো. মহিবুল্লাহ।
গত রোববার সকালে বাগেরহাট সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দেখা যায়, চার শয্যার বিপরীতে চিকিৎসা নিচ্ছে ২৭ জন। তাদের মধ্যে ২৩ জনই শিশু। শয্যার সংকুলান না হওয়ায় মেঝের পাশাপাশি হাসপাতালের নতুন ভবনের আইসোলেশন ওয়ার্ডের দুটি কক্ষে ডায়রিয়া রোগীদের রাখা হয়েছে।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের মেঝেতে চিকিৎসা নেওয়া মোরেলগঞ্জের উত্তর সুতালড়ি গ্রামের শিশু রেহানের মা পারভীন বেগম বলেন, গত শনিবার দুপুরে রেহানের জ্বর ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। পরে স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়ান। পরে রাত ২টার দিকে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক না পেয়ে রোববার সকালে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করান।
চার বছর বয়সী নাতি রোমানকে নিয়ে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রয়েছেন সদর উপজেলার বেসরগাতি এলাকার রুমিসা বেগম। তিনি বলেন, ‘নাতি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। হাসপাতাল থেকে শুধু স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অন্যান্য ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু আগে জানতাম, রোগীর ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দেয়। আমরা গরিব মানুষ। এত ওষুধ কীভাবে কিনব?’
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত দুই ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আসা বাগেরহাট সদর উপজেলার বেতখালি এলাকার আল আমিন বলেন, ‘চার দিন আগে ছোট ছেলেকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করিয়েছি। দুদিন থেকে চার বছর বয়সী বড় ছেলেরও বমি হচ্ছে। শনিবার তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি।’
গতকাল ফকিরহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, বহির্বিভাগে ডায়রিয়া রোগীর ভিড়। প্রতিদিনই ৭-৮ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়। হাসপাতালের ডায়রিয়া ইউনিটের শয্যা কানায় কানায় পূর্ণ। এ ছাড়া বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও ভর্তি আছে অনেক রোগী। সব বয়সী মানুষই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। তবে আক্রান্তের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি।
ফকিরহাটের মূলঘর এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন শেখ বলেন, দুদিন আগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া তিন বছরের শিশু সোহেলীর পরিবার তাকে দুদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে বলে জানান তার স্বজনেরা। অন্যদিকে পাঁচ বছরের শিশু লামিয়ার পরিবার জানায়, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত রোববার সকালে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার ওষুধ ও স্যালাইন চলছে।
বাগেরহাট সদর হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডের নার্স আসমা বেগম বলেন, শিফট অনুযায়ী তাঁরা রোগীদের সেবা দেন। কিন্তু অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সুদেব দেবনাথ বলেন, গত শনিবার রাতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছয়জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদে মধ্যে বেশির ভাগ রোগীই পানিশূন্যতা নিয়ে ভর্তি হয়। এ ছাড়া যেসব রোগীর ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দেবে, তাদের বেশি করে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে নির্ধারিত শয্যা চারটি। কিন্তু প্রতিদিন এখানে ২০ থেকে ২৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়। আবার ১০-১৫ জন সুস্থ হয়ে ফিরে যায়। কয়েক গুণ বেশি রোগীর সঠিক চিকিৎসা দিতে ডায়রিয়া ওয়ার্ডের জন্য চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া নতুন ভবনের দুটি কক্ষ ডায়রিয়া রোগীদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। সব ডায়রিয়া রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সব ধরনের ওষুধ, স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
অসীম কুমার সমাদ্দার আরও বলেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে বর্তমানে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে বিশুদ্ধ পানি পানের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। সেই সঙ্গে সুস্থ মানুষকে বেশি বেশি তরল খাবার ও মাঝে মাঝে খাওয়ার স্যালাইন খেতে হবে। পাতলা পায়খানা ও বমি বেশি হলে বাড়ি না থেকে হাসপাতালে যাওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
ফকিরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. হাসিবুর রহমান বলেন, এই অঞ্চলে বেশির ভাগ টিউবওয়েলের পানি লবণাক্ত। অনেকে পুকুরের পানি পান করে অসুস্থ হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তারা বিনা মূল্যে ক্লোরিন ট্যাবলেট দেন। সামান্য গন্ধ থাকায় অনেকে খেতে চায় না। তবে ২০ লিটার পানিতে একটি ট্যাবলেট দিলে তা নিরাপদ পানি হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শাহ্ মো. মহিবুল্লাহ বলেন, ‘ডায়রিয়া মূলত পানিবাহিত রোগ। তাই পরিচ্ছন্নভাবে খাবার গ্রহণ ও বিশুদ্ধ পানি পান করলে প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা গেলে সহজেই এ রোগ থেকে আমরা মুক্তি পাব।
Discussion about this post