মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘুঁটি ইসরায়েল। সে হিসেবে ঘনিষ্ঠতম মিত্র। এই সূত্রে পুরো পশ্চিমের সঙ্গেই ইসরায়েলের সম্পর্কও বেশ উষ্ণ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক হিসাব নিকাশই গুলিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের মতভেদের কথা জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে ইরান এই সুযোগে পরমাণু চুক্তিকে ইস্যু করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে উঠেপড়ে লেগেছে।
বাকি থাকল মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবেধন নীলমণি—ইসরায়েল! ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমের সঙ্গে তারা দূরত্ব রেখেই চলছে। বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও এই পদক্ষেপে শামিল হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল এ নিয়ে পশ্চিমের এমন সংকট সময়ে ইসরায়েলের এমন নির্লিপ্ত ভাব কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? মিত্রদের বিপদের সময় এভাবে গা বাঁচিয়ে চলাটা কি মধ্যপ্রাচ্যের ‘বৈরী দেশ’ হিসেবে ইসরায়েলকে সম্ভাব্য বিপদের দিকে ঢেলে দিচ্ছে? সবকিছু জেনেও কেন ইসরায়েল এমন ঝুঁকির পথে পা ফেলছে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যে পুরো বিশ্বের ভূরাজনীতি পাল্টে দেবে এটুকু অন্তত এখন বলা যেতেই পারে। সেই পরিবর্তিত বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্য ও ইসরায়েল সম্পর্কও নতুন করে নির্ধারিত হবে—সেটি সহজেই অনুমেয়। এরপরও কিছু ইঙ্গিত তো মিলছে!
ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েল রুশ অলিগার্কদের ভাগ্য নিয়েও লড়াই করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া থেকে কয়েক ডজন ইহুদি টাইকুন ইসরায়েলি নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমতি নিয়েছেন বলে জানা যায়।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে এমন ব্যবসায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ইসরায়েল এই প্রবণতা উৎসাহিত করছে। জানা যাচ্ছে, তারা কয়েক ডজন ইহুদি রুশ অলিগার্কের সঙ্গে কাজ করছে।
বিষয়টি নিয়ে খুব সাবধানে এগোচ্ছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সরকার একটি উচ্চ-পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। কীভাবে পুতিনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তকে লক্ষ্য করে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ইহুদিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে তার মর্যাদা বজায় রাখতে পারে—এ বিষয়টিই খতিয়ে দেখবে এ কমিটি।
জানা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া থেকে যে কয়েক ডজন ইহুদি টাইকুন ইসরায়েলি নাগরিকত্ব বা আবাসনের অনুমতি নিয়েছেন ক্রেমলিনের সঙ্গে তাঁদের অনেকেরই সম্পর্ক বেশ ভালো। এর মধ্যে অন্তত চারজনের নাম করা যায়—ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচ, মিখাইল ফ্রিদমান, পিতর আভেন এবং ভিক্তর ভেকসেলবার্গ। পুতিনের সঙ্গে কথিত বিশেষ যোগাযোগের কারণে তাঁরা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন।
এদিকে খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইসরায়েল। সম্প্রতি ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজে দেওয়া সাক্ষাৎকারের ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জেরুজালেমকে দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এ নিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেতের সঙ্গে পুতিনের একাধিকবার ফোনালাপও হয়েছে।
আর ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পদক্ষেপে যোগ দিচ্ছে না ইসরায়েল। অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে ওই তালিকায় নাম লেখানোর চাপও তত বাড়ছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি টিভি স্টেশন চ্যানেল ১২-এ একটি সাক্ষাৎকারে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ফর পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলকেও যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে নুল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি ইসরায়েলকে উদ্দেশ করে বলেছেন সেটি হলো—আপনি নিশ্চয়ই নোংরা অর্থের শেষ আশ্রয়স্থল হতে চান না। যেটি পুতিনের যুদ্ধে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান কূটনীতিক অ্যারন ডেভিড মিলার টুইটারে বলেছেন, নুল্যান্ডের এই মন্তব্য সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে বা দীর্ঘকালীন কোনো নীতির প্রশ্নে ইসরায়েলের নীতির প্রতি সবচেয়ে ক
ইহুদিদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ফিলিস্তিনের ভূমে প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েল রাষ্ট্র ইহুদি বংশোদ্ভূত যে কাউকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব দেয়। ৩০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া এবং অন্যান্য সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র থেকে আনুমানিক ১০ লাখ ইহুদি ইসরায়েলে চলে গেছে। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের টাইকুনরা সেই স্রোতে যুক্ত হতে শুরু করেছেন।
এর মধ্যে কেউ কেউ আবার, যেমন— সাবেক জ্বালানি ম্যাগনেট লিওনিদ নেভজলিন এসেছেন পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পর। অন্যরা নিজ দেশে ঝামেলায় পড়ার পর আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন ইসরায়েল।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আব্রামোভিচের নাম। ব্রিটিশ ভিসা নবায়ন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর ২০১৮ সালে ইসরায়েলি নাগরিকত্ব নেন তিনি। ইংল্যান্ডে একজন সাবেক রুশ গুপ্তচরকে বিষ প্রয়োগে হত্যার পর ব্রিটেন পুতিনের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যখন ব্যবস্থা নেয়, সেই তালিকায় পড়ে যান আব্রামোভিচ। অবশ্য ইসরায়েলে খুব একটা থাকেন না তিনি। কিন্তু পছন্দ করে বেশ কয়েকটি রিয়েল এস্টেট কিনেছেন।
এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রচার থেকে দূরে থাকেন, কেউ ইহুদি শিকড়কে আলিঙ্গন করেছেন, কেউ ইহুদি স্বার্থরক্ষায় জনহিতৈষী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, আবার কেউ ইসরায়েলের আশ্চর্য উদীয়মান প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করেছেন।
ইসরায়েলি মিডিয়াগুলো সম্প্রতি দেশে অলিগার্কদের ব্যক্তিগত জেট ওড়াউড়ির খবর দিয়েছে। চ্যানেল ১২ রোববার (১৩ মার্চ) জানিয়েছে, আব্রামোভিচের একটি জেট এসেছে। যদিও তিনি বিমানে ছিলেন কি না স্পষ্ট নয়।
গত সপ্তাহে পর্তুগালে এক ইহুদি রাব্বি গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে আব্রামোভিচের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে তিনি সহযোগিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই রাব্বি তথ্য গোপন করে আরও অনেককে নাগরিকত্ব পাইয়ে দিয়েছেন—এমন অভিযোগের তদন্ত করছে পুলিশ।
আগের দৃষ্টান্ত থেকে জানা যায়, ইসরায়েল যখন কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ বিবেচনা করে, তখন সারা বিশ্বেই ইহুদি সংগঠনগুলো সেগুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এবার তারা ইসরায়েলের আগেই রুশ অলিগার্কদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে তৎপর হয়ে উঠেছে।
Discussion about this post