
স্টাফ রিপোর্টার
বাংলাদেশ রেলওয়ের অন্যতম যাত্রীবাহী ট্রেন “১১ সিন্দুর এক্সপ্রেস” বর্তমানে শুধু যাত্রী নয়, পুরো ব্যবস্থাপনাই যেন জিম্মি একটি প্রভাবশালী ঠিকাদারি গোষ্ঠীর হাতে। ক্যান্টিন, খাবার সরবরাহ, পরিচ্ছন্নতা ও আসন ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করছে সুরুচি ফাস্ট ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড এবং ভুটান বেভারেজ লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠান, যার আড়ালে রয়েছেন বিতর্কিত ঠিকাদার আব্দুর রাজ্জাক। অভিযোগ উঠেছে—রাজনৈতিক পরিচয়, অর্থ-বাণিজ্য এবং ক্ষমতার দাপটে তিনি রেলপথে গড়ে তুলেছেন একচ্ছত্র প্রভাব।
ঠিকাদারি দুর্নীতির অভিযোগ
আব্দুর রাজ্জাক দীর্ঘদিন ধরেই ‘১১ সিন্দুর এক্সপ্রেস’ ও ‘কালনী এক্সপ্রেস’ ট্রেনের খাবার ও পরিষেবা কার্যক্রম নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, একই ঠিকানায় একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র জমা দিয়ে নিয়ম ভঙ্গ করে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। রেল মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী, দরপত্রে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছে অন্যান্য প্রতিযোগীদের।
শ্রমিক শোষণ : মজুরি নেই, মর্যাদা নেই
“১১ সিন্দুর” ও “কালনী” ট্রেনে কর্মরত প্রায় ৬৫ জন শ্রমিকের অধিকাংশই মাসিক নির্ধারিত ১২ হাজার টাকা বেতন পেলেও তা ব্যাংক থেকে তুলে আবার মালিক পক্ষকে ফেরত দিতে বাধ্য হন। বাকি অন্তত ৩০ জন শ্রমিক বিনা বেতনে, বিনা নিয়োগপত্রে, বিনা নিরাপত্তায় কাজ করছেন। নামমাত্র বেতনের পরিবর্তে বাধ্য করা হয় জোরপূর্বক অর্থ জমা দিতে। প্রতিদিনের খাবার বিক্রি থেকেও কাটে কমিশন।
এক সাবেক শ্রমিক মো. আরিফুল ইসলাম (বরিশাল) বলেন,
“এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকা দিয়ে চাকরি নিই। ৫ মাস কাজ করার পর সামান্য ভুলের দায়ে চাকরি যায়। কোনো ছুটি নেই, খাবার খরচও নিজের। জামানতের টাকা ফেরত দেয়নি।”
মো. রফিকুল ইসলাম (বরগুনা) বলেন,
“জ্বর হওয়ায় ৫ দিন কাজে না যাওয়ায় চাকরি চলে যায়। ৯ মাসের বেতন একটাকাও দেয়নি।”
মো. কামরুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ) অভিযোগ করেন,
“প্রতিমাসেই ৭-৮ জনকে চাকরি দিয়ে পরে বাদ দেওয়া হয়। এটাই তাদের মূল ব্যবসা।”
টিকিটবিহীন যাত্রী, অতিরিক্ত আসন, চাঁদাবাজির অভিযোগ
এই ট্রেনে নিয়মিতভাবে ফাঁকা স্থানে অতিরিক্ত চেয়ার বসিয়ে যাত্রী উঠিয়ে ভাড়া আদায় করা হয়। এসব অর্থ শ্রমিকদের হাত ঘুরে “ম্যানেজারদের” কাছে পৌঁছায়। ট্রেনযাত্রী নাজমুল হাসান অভিযোগ করে বলেন,
> “১৬০ টাকায় বিরিয়ানি নিয়েছিলাম—খাওয়া যায়নি। ফেরত চাইলে খারাপ ব্যবহার করে।”
খাদ্যমানের অবনতি ও যাত্রী ভোগান্তি
ট্রেনে পরিবেশিত খাবার অধিকাংশ সময় নিম্নমানের, বাসি ও অতিমূল্যবান। ৩০-৫০ টাকার খাবার ১০০+ টাকায় বিক্রি হয়। ফেসবুক ও যাত্রীদের মন্তব্য থেকে জানা গেছে—জল ছাঁকা নয়, বোতলজাত দূষিত পানি পরিবেশন করা হয় নিয়মিত।
রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও ঠিকাদার রাজত্ব
আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি একসময় নিজেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাগিনা হিসেবে পরিচয় দিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একাধিক টেন্ডার বাগিয়ে নেন। সেই সুযোগে প্রতিষ্ঠা করেন “কমলাপুর রাজত্ব”। সময়ের সাথে তিনি বিএনপি নেতাদের নাম ভাঙিয়ে নতুন চুক্তিও নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তদন্তে ‘উপরে থেকে চাপ’
রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে গোপন আলাপচারিতায় জানা গেছে—এ ধরনের অভিযোগ তদন্ত হলেও ‘উপরে থেকে চাপ আসে’, ফলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। সুরুচি ফাস্ট ফুড ও ভুটান বেভারেজ এর চুক্তি নবায়ন ও তদন্ত ধামাচাপায় রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগানো হয়।
“১১ সিন্দুর এক্সপ্রেস” আজ রেলের নয়, ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের হাতে বন্দী। যাত্রীসেবা নয়, লক্ষ-কোটি টাকার শোষণব্যবস্থা পরিচালনাই যেন এর মূল উদ্দেশ্য।
এই ট্রেন যেন জীবন্ত উদাহরণ:
“যাত্রী নয়, ঠিকাদারই রাজা” – রেল ক্যান্টিনে দুর্নীতির ছায়া!”





Discussion about this post