
মোঃ কামরুল হাসান
বিশেষ প্রতিনিধি
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল যেন চলছে এক অদ্ভুত দোলাচলে—চালু, বন্ধ, আবার চালু! বারবার বন্ধ হওয়া ও চালু হওয়ার এ নাটকীয় চিত্র শুধু একটি হাসপাতালের নয়, বরং দেশের প্রকল্পনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো—প্রাণ বাঁচানো ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) পর্যন্ত এখন টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না স্থায়ী জনবল ছাড়া।
মাত্র একদিনের ব্যবধানে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগ বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়েছে। বুধবার (৩০ জুলাই) বিনাবেতনে কর্মরত চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ করে দিলে বিভাগটি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। তবে বৃহস্পতিবার সকালে তিনজন চিকিৎসককে নতুন করে পদায়ন করায় পুনরায় চালু হয় বিভাগটি।
আইসিইউ ইনচার্জ ডা. কফিল উদ্দিন জানান, গত ৯ মাস ধরে পাঁচজন চিকিৎসক ও ছয়জন কর্মচারী কোনো বেতন ছাড়াই সেবা দিয়ে আসছিলেন। পরিবার-পরিজনের আর্থিক চাপে তারা দায়িত্ব পালনে অপারগতা জানানোর পর বাধ্য হয়েই বিভাগটি বন্ধ করতে হয়।
এ সংকট আইসিইউতেই সীমাবদ্ধ নয়। চলতি বছরের ৮ মে সিসিইউ বিভাগ চিকিৎসক সংকটে বন্ধ হয়ে যায়। পরে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ ও স্থানীয়দের চাপে সরকারিভাবে দুজন চিকিৎসক নিয়োগ দিলে ১৩ মে থেকে বিভাগটি পুনরায় চালু হয়।
এই বারবার বন্ধ হওয়ার প্রবণতা রোগীদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলছে এবং স্বাস্থ্যখাতের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করছে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রকল্প (এইচজিএসপি)’-এর আওতায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চালু হয়েছিল আইসিইউ, সিসিইউ, জরুরি প্রসূতি ও শিশু সুরক্ষা বিভাগ। নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল অতিরিক্ত ১৯৯ জন জনবল। তবে ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে সেপ্টেম্বরের পর তা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রকল্প শেষ হলেও চিকিৎসকদের কিছু অংশ এখনো বিনা বেতনে কাজ করছিলেন, তবে বাস্তবতা বলছে—দীর্ঘদিন বিনা পারিশ্রমিকে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। ফলে ধীরে ধীরে এসব বিশেষায়িত বিভাগগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
সদর হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, অনুমোদিত ৩২৮টি পদের মধ্যে ৭৬টি পদ শূন্য। অথচ ইনডোরে প্রতিদিন গড়ে ৭০০-৮০০ রোগী ভর্তি থাকেন, এবং জরুরি বিভাগে সেবা নিতে আসেন ৫০০ থেকে ১,০০০ জন রোগী। অথচ জরুরি বিভাগে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে সেবা চালানো হচ্ছে, যেখানে প্রয়োজন কমপক্ষে ১২ জন।
বারবার বন্ধ হওয়ার এই পরিস্থিতি জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বেড়েছে বহুগুণ, সেখানে এ ধরনের অনিশ্চয়তা বড় ধাক্কা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্পনির্ভর বিশেষায়িত সেবা দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন স্থায়ী পদায়ন, সরকারি অর্থায়ন ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা।
একজন সিনিয়র চিকিৎসক বলেন:
“এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলো স্থায়ী রূপ না পেলে রোগীরা বারবার বিপদে পড়বেন। স্বাস্থ্যখাতকে প্রকল্পনির্ভরতামুক্ত করতে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন।”
চলমান সংকটের মাঝেও কিছুটা আশার আলো হলো, কর্তৃপক্ষ এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে চিকিৎসা, বিশেষ করে সংকটাপন্ন রোগীদের সেবা নিয়ে ‘নাটকীয়তা’ চলতে থাকলে তা স্বাস্থ্যখাতের মৌলিক কাঠামোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।





Discussion about this post