
টিপু মাহমুদ
একসময় জুয়া ছিল গোপনে সীমিত কিছু মানুষের আসক্তি, যা হতো হাট-বাজারের আড়ালে কিংবা নির্দিষ্ট স্থানে। কিন্তু ইন্টারনেটের অবাধ প্রবাহ, স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেমের সুবিধা এই পুরনো আসক্তিকে নতুন রূপ দিয়েছে। এখন হাতে একটি মোবাইল ফোন আর সামান্য ইন্টারনেট থাকলেই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে মানুষ জুয়ার টেবিলে বসে যাচ্ছে—শুধু টেবিলটি আর কাঠের নয়, বরং ভার্চুয়াল স্ক্রিনের ভেতরে।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অনলাইন জুয়া বা ‘গেম্বলিং’ একটি ভয়ংকর সামাজিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় মানুষ ঘরে বন্দি থাকায় অনলাইন গেম ও জুয়ার প্রতি ঝোঁক হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটকের বিজ্ঞাপন ও গোপন লিঙ্কের মাধ্যমে যুব সমাজ টেনে নেওয়া হয় এই আসক্তির দুনিয়ায়। ছোট আকারের ‘ফ্রি গেম’ দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে যুক্ত হয় টাকা লেনদেন—এবং সেখানেই শুরু হয় সর্বনাশের পথচলা।
বিশেষ করে ‘ক্র্যাশ গেম’, ‘ক্যাসিনো স্লট’, ‘অনলাইন বেটিং’ ও ‘পোকার’-এর মতো অ্যাপ ও ওয়েবসাইটগুলো রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এগুলোর পেছনে থাকে আন্তর্জাতিক চক্র, যারা বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের তরুণদের লক্ষ্য করে ব্যবসা চালায়। তাদের উদ্দেশ্য শুধু মুনাফা নয়, বরং একবার আসক্ত করে আজীবনের জন্য টাকা খাওয়া।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো—এই অনলাইন জুয়ায় আসক্তির কারণে অনেক তরুণ পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, কর্মজীবন ধ্বংস করছে, এমনকি ঋণগ্রস্ত হয়ে অপরাধের পথে নামছে। পারিবারিক কলহ, আত্মহত্যা এবং অপরাধের ঘটনা বেড়ে গেছে। এক সময় পরিবারের গোপন সঞ্চয়, গহনা বা বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা টাকা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে এই জুয়ার আসরে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও প্রযুক্তিগত কারণে অনেক চক্র ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বিদেশি সার্ভার ও এনক্রিপ্টেড পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে তারা নিরাপদে লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে।
আজ হয়তো কেউ কেউ এটিকে হালকা বিনোদন বলে ভাবছেন, কিন্তু সত্য হলো—এই আসক্তি ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটি গোটা প্রজন্ম যদি মেধা, সময় ও অর্থ অনলাইন জুয়ার পেছনে নষ্ট করে ফেলে, তাহলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি—সবই মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।





Discussion about this post